Blogroll

মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা কাহিনী

লালন ফকির, মীর মোশারফ হোসেনের দেশ কুস্টিয়া। এখানে রয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিময় কাহিনী। এমনি এক কাহিনী যা আজকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি, যা রয়ে গেছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। কুস্টিয়া শহর থেকে ৯ কিমি. পূর্বে লালন ও মীর মোশারফ হোসেনের বাস্তুভিটা ছেড়ে গড়াই নদী পেরিয়ে মনোহরপুর গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সময় কালের এক ভয়াবহ কাহিনী। শান্ত শিষ্ট নিবিড় ঘন সবুজ ঘেরা মনোহরপুর গ্রামের অবস্থান কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নে। 


১৯৭১ সাল ও তার পরেও দীর্ঘ অনেকদিন এখানকার মানুষেরা জীবন-যাপন করতো ছয়মাস পানিতে ঘেরা থাকা অবস্থায় ও ছয় মাস শুস্ক অবস্থায়। আমি যে সময় কার কথা বলছি সে সময় ছিল মনোহরপুর সহ আশেপাশের গ্রাম সহ পানি বন্দী। মানুষ চলাচল করতো নৌকা অথবা কলার ভেলাতে। ১৯৭১ সালের ১৪ই আগস্ট সকাল, রাতের অন্ধকার পেরিয়ে সকালে কর্মময় হয়ে উঠেছে মনোহরপুর গ্রাম। আনুমানিক সকাল ৯.৩০ মিনিটে সদরপুর ও মনোহরপুর গ্রামের সীমান্তে থেকে হটাৎ বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ ভেসে আসলো। সঙ্গে সঙ্গে নিরব  সবুজে ঘেরা মনোহরপুর গ্রামের পাখি ও কাকেরা কোলাহল করে উড়ে গেল অন্যত্র। সবার মধ্যে আশংকা কি ব্যাপার গুলি কেন হল? জানা গেল কিছুক্ষন পরে পঁচা গড়াই নামে খালে স্রোতে ভেসে যাওয়া ডুবে থাকা জঙ্গলের মাঝে দুটি লাশ। সেই পঁচা গড়াই এ এখন কোন স্রোত নেই, তবে খালটি আছে। কে এই দুটি লাশ, আজ আমরা সেই কাহিনীটি জানবো ।

শহীদ ইয়াজউদ্দীন মোল্লা যাকে সবাই পরোপকারী মানুষ হিসেবে চিনতেন, তিনি শুধু পরোপকারী মানুষই ছিলেন না। তিনি মনোহরপুর গ্রামের মসজিদে আজান দিতেন ও ইমামতি করতেন, পাশাপাশি মানুষকে দিতেন হোমিও চিকিৎসা, এবং তার পুত্র শহীদ আমিনুল ইসলাম মোল্লা যিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। এ দুজন সহ ইয়াজউদ্দীন মোল্লার ছোট ছেলে মরহুম নজরুল ইসলাম মোল্লা যিনি গত জুন ২০১১ তে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তারা নৌকায় করে কাজে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে জানতে পারেন যে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার ও মনিরের বাবা আজিমকে রাজাকার জলিলের নির্দেশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে হত্যার উদ্দেশ্যে, সে সময় ইয়াজউদ্দীন মোল্লা সহ তার পুত্ররা রাজাকারদের হাত থেকে আজিমকে বাঁচানোর জন্য রাজাকারদের সাথে কথা কাটাকাটি  ও ধস্তাধস্তি শুরু হলে রাজাকার কমান্ডার জলিলের নির্দেশে রাজাকার ইসমাইল, আশরাফ ও হিরন তারা ইয়াজউদ্দীন মোল্লা সহ তার পুত্রদের উপর গুলি বর্ষণ করে মৃত নিশ্চিত জেনে নিরস্ত্র ইয়াজউদ্দীন মোল্লা ও তার পুত্রদ্বয় কে পানিতে ভাসিয়ে দেয় পঁচা গড়াইয়ের স্রোতে। শহীদ হন ইয়াজউদ্দীন মোল্লা ও আমিনুল ইসলাম। সৌভাগ্য ক্রমে তিনটি গুলি লেগেও বেচে যান নজরুল ইসলাম মোল্লা। আর এ সবই দেখছিলেন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মিয়া (মিঠু) তার করার কিছু ছিলনা, সেও কোন রকম পালিয়ে জীবন রক্ষা করে। সবাই জেনে গেল ইয়াজউদ্দীন মোল্লা পুত্র সহ রাজাকাররা হত্যা করেছে। স্রোতের পানিতে ভেসে যাওয়া লাশ পাওয়া গেল পঁচা গড়াইতে। গোটা মনোহরপুর বাসী সেদিন স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল। এরকম পরোপকারী মানুষ, মসজিদের খেদমতগার ইয়াজউদ্দীন মোল্লাকে কি করে ইসলাম রক্ষার নামে রাজাকাররা হত্যা করলো। শহীদ দুজনের জানাজা হল মনোহরপুর মসজিদে ও দাফন হল মনোহরপুর গোরস্থানে। আমি নিজে তখন অনেক ছোট। আমিও ছিলাম সে জানাজা ও দাফনে। আজ অনেক দিন পর সেই গ্রামে এসে মনে পড়লো সে কাহিনী, তাই এ লেখা। 
( তথ্য প্রদানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন খাঁন )
 
( প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মিয়া(মিঠু)
আমাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন খাঁন, সঙ্গে ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মিয়া(মিঠু)। তারা জানালেন ঐ পরিবারের শহীদ আমিনুল ইসলাম মোল্লার বিধবা স্ত্রী ও তার সন্তানেরা এখনও জীবিত। তারা পায়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বীকৃতি। অতি সম্প্রতি একটি বে- সরকারী টিভি চ্যানেল এই কাহিনীটি প্রচার করে। আমিনুল ইসলাম মোল্লার বিধবা স্ত্রী মনোয়ারা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতির জন্য সংশ্লিস্ট কতৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। আজও ঐ পরিবার সহ মনোহরপুর বাসী, যে রাজাকাররা এই জঘন্য কাজ করেছে তাদের এখনও এই স্বাধীন দেশে বহাল তবিয়তে বিচরন করতে দেখছে। তারা সবাই জীবিত। এই গ্রামে প্রায় দশ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যাদের অনুপ্রেরনা দিতেন শহীদ আমিনুল ইসলাম মোল্লা। আজও এই গ্রাম বাসীর মনে সেই ভয়াল ১৪ আগস্ট ১৯৭১ সালের সেই দিন গুলির কথা মনে আছে।

দেশ আজ স্বাধীন। এই স্বাধীন দেশে আজও সেই নরপুশু ঘৃণিত রাজাকারেরা বুক ফুলিয়ে চলে। এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা সহ গ্রামবাসী সেই হত্যাকান্ডের বিচার এখনও চায়।

সেই সাথে আজ আমি আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই “ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস”  এর পিডিএফ সংস্করণ টি উপহার দিলাম। ডাউনলোড করে রাখুন এখান থেকে।
ধন্যবাদ সহ-
মোঃ জাকির হোসেন
১২.০৭.২০১১
আমার আরও লেখা দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
These icons link to social bookmarking sites where readers can share and discover new web pages.
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google
  • Furl
  • Reddit
  • Spurl
  • StumbleUpon
  • Technorati

Leave a comment

Admaya